আজ নিয়ে যাবো আপনাদের এক নায়কের গল্পে… মুভির নায়ক নয় কেনোনা তার সবটাই অভিনয় কিন্তু ক্রিকেট মাঠে দেশের হয়ে বল ব্যাট হাতে বাস্তবতা জয় করে আনা এমন এক নায়কের কিছু নায়কচিত অবদানের কথা আজ আপনাদের আমি শুনাবো যার জন্য হয়ত অনেকের মনেই কোনো স্থান নেই কেনোনা নায়ক বলে কোনো শব্দ যে তার ক্যারিয়ারে নেই!
কেমার রোচের একের পর এক ঘন্টা প্রতি ৯০ মাইল বেগে ছুটে আসা বল গুলোতে নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছেন আমাদের ব্যটসম্যানেরা। নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান তামিম তো সেই বহু আগেই বিদায় নিয়েছেন আর এদিকে জুনায়েদ, রকিবুল ও সাকিবের উইকেট নিয়েও বসে আছেন রোচ।
সেন্ট কিটসের ওয়ার্নার পার্কে ৩য় ও শেষ ওডিয়াইতে ক্যারিবিয়দের দেয়া ২৪৯ রানের টার্গেটে তখন আমাদের ১৩৩ রানেই নেই ৫ উইকেট! রোচের সাথে স্যামিও যখন একে একে নিভিয়ে দিচ্ছিল তাদের হোয়াইট ওয়াশ করার স্বপ্ন তখন কে জানতো ৩১ জুলাইয়ের ঐ দিনটিতেই মাহমুদুল্লাহ পেতে যাচ্ছেন জীবনের প্রথম ম্যাচ সেরা হওয়ার পুরষ্কার!
এমন অবস্থায় ক্রিজে এসে প্রতিপক্ষের পেস এ্যাটাককে বৃদ্ধাংগুলি দেখাতে দেখাতে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে ৭০ বল থেকে ৫১ রানের অপরাজিত এক ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেলে ফেললেন রিয়াদ। সেই সাথে বল হাতেও ইনিংস সেরা ৩২/২ ফিগার নিয়ে দলকে ৩ উইকেটের জয় এনে দিয়ে টেস্ট খেলুড়ে কোনো প্রতিপক্ষকে দেশের বাইরে প্রথম বারের মত হোয়াইট ওয়াশ করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখলেন তিনি ঐদিন।
দুই
৯ জুলাই, ২০০৯ সেন্ট ভিনসেন্ট দ্বীপের কিংসটাউনের দি আর্নোস ভেল গ্রাউন্ডে সাদা পোষাকে অভিষেক হল এক বাংলাদেশী অলরাউন্ডারের। বরাবরের মত টেস্টে বল হাতে নির্বিষ তকমা নিয়ে বাংলাদেশ বোলিং শুরু করতেই ৩৯ রানে প্রতিপক্ষের ৩টি উইকেট তুলে নিয়ে এই অলরাউন্ডার ১ম ইনিংসের সেরা বোলার হয়ে গেলেন। আর ২য় ইনিংসে তো অফ স্পিনের জাত চিনিয়ে ছাড়লেন ক্যারিবিয় ব্যাটসম্যানদের… যার ফলে তিনি তৃতীয় বাংলাদেশী বোলার হিসেবে টেস্ট অভিষেকেই পাঁচ উইকেট লাভের মর্যাদা পেয়ে গেলেন।
ব্যটসম্যান ওয়ালটন ও রেফার তো তার ঘুর্ণি একেবারেই ধরতে পারেননি সেবার যার ফলে দুই ইনিংসেই তারা দুবার করে শিকার হন এই অলরাউন্ডারের। আর মূলত ম্যাচে এই অলরাউন্ডারের ৯০/৮ বোলিং ফিগারই বাংলাদেশকে বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয় এনে দেয়… অলরাউন্ডার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের হাত ধরে।
তিন
২৪ জানুয়ারি ২০১০, মিরপুরে ২য় টেস্টে বাংলাদেশের দুই ওপেনার তামিম ও ইমরুল ডাক খেয়ে সাজঘরে অতঃপর জহির খানের রিভার্স, ঈষান্ত শর্মার বাউন্স ও প্রজ্ঞান ওঝার ঘূর্ণিতে বাংলাদেশের স্কোর তখন ১০৬/৬। এমন সময় ক্রিজে ব্যাট হাতে সেই অলরাউন্ডার রিয়াদের আগমন এবং ভারতীয় বোলারদের প্রতিরোধ করতে যেনো বাংলাদেশের হয়ে তার দূর্গ গঠন! সাকিবকে নিয়ে তার ২১, শাহাদাতকে নিয়ে ২৮, শফিউলকে নিয়ে ৫৮ এবং সবশেষে রুবেলকে নিয়ে ২০ রানের এমনসব কার্যকরী জুটি গড়ে গড়েই বাংলাদেশকে নিয়ে যান ২৩৩ রানের সম্মানজনক স্কোরে। সেদিন তিনি ১৫৬ বল খেলে ৯৬ রানে অপরাজিত থেকেই সাজঘরে ফেরেন আর বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমীদের মনে দিয়ে যান দ্রুত উইকেট পরলেও তার ব্যাটে ভরসা রাখার আস্থা… কেবল তিনি বল হাতেই নন ব্যাট হাতেও জ্বলে উঠতে পারেন তার একটা নমুনা।
চার
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হ্যামিলটন টেস্টে বাংলাদেশ প্রথম বারের মত ৪০০ এর ঘরে রান তুলল ১৯৬ রানে ৬ উইকেট পরে যাওয়ার পরেও! কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হল? সেদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রিয়াদকে ৮ নম্বরে বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে নামনো হলেও ১৭৭ বল থেকে ১১৫ রানের অসধারণ এক ইনিংস খেলে নিজেকে পরিপূর্ণ ব্যাটসম্যান হিসেবেই উপস্থাপন করলেন এবার দেশবাসীর কাছে।
মজার ব্যাপার হল ঐ ম্যাচে কিউইদের ২য় ইনিংসে ৫ উইকেট পরলেও রিয়াদ ২টি ছাড়া আর কোনো বোলারই উইকেট পাননি… বাকি ৩টি উইকেট আসে রান আউট থেকে। আর দেশের ক্রিকেট প্রেমীরা রিয়াদকে তখন ভাবতে শুরু করল সাকিবেরই পরিপূরক একজন অলরাউন্ডার হিসেবে। টেস্ট ইতিহাসের কোনো ইনিংসে প্রথম ৩টি উইকেট এই রান আউট থেকে আসাটাও একমাত্র রেকর্ড হয়ে আছে ঐ ম্যাচে।
পাঁচ
বেলফাস্টের ২০ জুলাই দিনটিতে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে প্রথম কোনো টিটুয়েন্টিআই সিরিজ জয় থেকে খানিকটা দূরে। আর শেষ ওভারে প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ডকে ৮ রান নেয়া থেকে আটকাতে পারলেই কেবল তা সম্ভব হবে। ৩ ওভার বোলিং করে ২২ রান দিয়ে উইকেট শুন্য থাকা মাহমুদুল্লাহর হাতেই বল তুলে দিলেন অধিনায়ক এমন সময়ে। ক্রিজে ৪১ রান নিয়ে থাকা জয়েস ও ১২ রান নিয়ে থাকা পয়েন্টারকে দেখেই বুঝি অধিনায়কের এই গ্যাম্বলিং। আর রিয়াদও এই দুজনকেই ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম টিটুয়েন্টিআই সিরিজ নিশ্চিত করল ১ রানের জয় দিয়ে। কিন্তু অধিনায়ক সেদিন গ্যাম্বলিঙ করুক আর নাই বা করুক রিয়াদ কিন্তু ২০১২ এর এই ম্যাচের পর থেকে এখনো পর্যন্ত টিটুয়েন্টি ম্যাচগুলোতে নিজেকে বারে বারে ডেথ বোলিং স্পেশালিস্ট হিসেবেই প্রমাণ করে যাচ্ছেন।
ছয়
চট্টগ্রামের মাটিতে ১১’বিশ্বকাপ কোয়াটার ফাইনালের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখাটা যেনো ভেস্তে যাচ্ছিল আমাদের ১৬৯/৮ স্কোরকার্ডের চেহারার দোষে! অথচ ঐ দিনটির পর থেকে আমরা যেনো আবারো আস্থা রাখতে শিখলাম আস্থা না হারানোর উপরে। কেনোনা এন্ডারসন, শেহজাদ, ব্রিজনান, সোয়ানের মত জয়ের নেশায় ভয়ংকর হয়ে ওঠা বোলারদের বিপক্ষে শফিউলকে নিয়ে রিয়াদের সেদিনের অপরাজিত ৫৮ রানের জুটিটি আমাদের অনেকটা অকল্পনীয়ভাবেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২ উইকেটের জয় এনে দেয়! তার ঠান্ডা মাথায় খেলা ৪২ বল থেকে ২১ রানের ছোট্ট কিন্তু মহামুল্যবান ঐ ইনিংসটি কোনো বিশেষণ দিয়ে বোঝানো যাবেনা কখনই বলে এটা নিয়ে বিস্তারিত লিখাও হয়ে ওঠেনি কখনো আমার।
সাত
২২ জুন ২০১২, বাংলাদেশ হারারের মাটিতে টিটুয়েন্টি ম্যাচে হারিয়ে দিল হাশিম আমলার দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৩ উইকেটের ব্যবধানে। মরিস, মরকেল, পার্নেল, লাংগের মত বোলারদের নিয়ে গড়া ফাস্ট বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ব্যাট থেকে ঐদিন মূল্যবান ২৮ রানের ইনিংসের বদৌলতে ও বল হাতে তার নেয়া ইনগ্রামের উইকেটটির সুবাদেই ১২৯ রানের টার্গেট অতিক্রম করে সে ম্যাচ আমাদের ঝুলিতে আসে।
আট
২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খুঁজছিল বড় কোনো একটি শিকার, যাকে হারিয়ে কোয়াটার ফাইনাল খেলার স্বপ্ন হবে পূরণ। অথচ বড় শিকার গুলো যখন একে একে হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখন একেবারে শেষ শিকার হিসেবে এডিলেডে বাঘের থাবায় ধরা দিল ইংল্যান্ড আর তা এবারো সেই রিয়াদের ব্যাটে। ইনিংসের শুরুতেই দুটি করে রান করে তামিম কায়েসের বিদায় নেয়ার পর এন্ডারসন, ক্রিস উকস, জর্দান, ব্রডদের গতি সুইং ও বাউন্সারের অথই সাগরে পরে যখন যেকোনো ব্যাটসম্যানেরই খাবি খাওয়ার কথা ঠিক তখনই রিয়াদ চালালো ইংলিশ এই বোলারদের উপর পাল্টা আক্রমণ। তার ম্যাচ সেরা পুরষ্কার জয়ী ১০৩ রানের ইনিংসের উপর ভর করেই ঐদিন বাংলাদেশ ২৭৫ রান জমা করে স্কোর বোর্ডে এবং দিন শেষে বৃটিষদের বিশ্বকাপ ছাড়া করে ১৫ রানের জয় দিয়ে।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এটি ছিল রিয়াদের অভিষেক সেঞ্চুরি এমনকি বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে বাংলাদেশের জন্যেও তা ছিল অভিষেক সেঞ্চুরি। ক্রিস উকসের থ্রোতে রান আউট হওয়ার আগে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বকাপের যে কোন উইকেটে মুশফিককে সাথে নিয়ে ১৪১ রানের সর্বোচ্চ জুটি গড়ে যান তিনি আগের ম্যাচে তামিমকে সাথে নিয়ে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেরই গড়া ১৩৯ রানের আরেক রেকর্ড জুটি নতুন করে ভেঙে।
নয়
১৩ মার্চ হ্যামিলটনের সেডন পার্কে বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্বের সর্বশেষ খেলায় অপরাজেয় হয়ে ওঠা কিউইদের বিপক্ষে ব্যাটিঙে নামার সঙ্গে সংগেই আবারো সাজঘরে আমাদের দুই ওপেনার। আর এবারো যেনো নিয়মকরে রিয়াদের ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠা সাউদি, বোল্ট, ম্যাক্লেনাঘান, কোরি ও ভেট্টোরিদের বিপক্ষে এবং সেই সাথে বিশ্বকাপে পর পর দু ম্যাচে টানা দুটি সেঞ্চুরিও পেয়ে যাওয়া। সেদিনের ১২৮ রানের অপরাজিত এই ইনিংসটি এখনো তার ওডিআই ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ইনিংস হয়ে আছে।
দশ
মাহমুদুল্লাহ সেই শুরু থেকেই তার এমনসব নজরকাড়া পারফরমেন্স দিয়ে তার উপর আমাদের ভরসা রাখতে শিখিয়ে আসছিলেন আর তার প্রতি এই ভরসা করাটা যেনো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর থেকে অনেকটা বাধ্যগত নিয়মেই পরিণত করলেন তিনি। ৩৩ রানে চার উইকেট পরে যাওয়ার পর সাকিবকে সাথে নিয়ে কার্ডিফে তার ২২৪ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপের সাথে দলকে ৫ উইকেটের অকল্পনীয় জয় এনে দিয়ে আইসিসি ইভেন্টে হাঁকালেন ৩য় বারের মত সেঞ্চুরি!
কি ছিলনা তার এই ইনিংসে! বলের লাইন লেন্থ গতি বাউন্স বুঝে বোল্ট, মিলনে, সাউদিকে কোনো খুঁত না দিয়েই ডিফেন্স ও শটস খেলে খেলে তাদের মনসংযোগে বিরক্তির প্রকাশ এনে দেয়া… উইলিয়ামসন বোলিঙে আসলে ছক্কা মেরে তাকে আবারো ফিল্ডিঙে পাঠিয়ে বুঝিয়ে দেয়া যে আপনি কেবল ব্যাটসম্যানই ভাইয়া আর ইকোনোমিকাল বোলিং করা স্যান্টানারকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে চারটি মারা তো এখনো চোখ থেকেই আমার সরছেনা! গত বিশ্বকাপের বিফলে যাওয়া সেঞ্চুরিটিকে যেনো এবার তিনি প্রাণ দিলেন এভাবেই অপরাজিত ১০২ রানের আরেকটি সেঞ্চুরি করে কিউইদের একেবারে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে ব্যাট দিয়ে টাটা জানিয়ে।
উপরের কেবল এই ১০টি ম্যাচ ছাড়াও আরো অনেক ম্যাচে দলের বিপদে হাল ধরার জন্য এই রিয়াদ তার দেশী বিদেশী ভক্তদের কাছে বিভিন্ন সময়ে পরিচিত হয়েছেন “মিস্টার রিলায়েবল”, “সাইলেন্ট কিলার”, “কুলেস্ট প্লেয়ার” এমনসব অসংখ্য বিশেষণে। আজ ২৫ জুলাই ক্রিকেট ইতিহাসের মাত্র অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে টানা দুই সেঞ্চুরির মালিক এই ক্রিকেটারের ১০ বছর পূর্ণ হল আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে। দেশের বাইরের অচেনা কন্ডিশনের সাথে সাথে বড় ম্যাচের চাপকে শীতল করে একের পর এক পারফর্ম করার কি এমন রহস্য তার… তা অজানাই থাক।
কেবল এমন নতুন নতুন রহস্য তৈরী করে তিনি তার ক্যারিয়ারকে যেনো ১০ বছর থেকে সুস্থভাবে ২০ বছরে নিয়ে যেতে পারেন এখন কেবল এই কামনায়। আর আমার লেখা শুরুর ভূমিকাটাও যেনো সময়ের বিবর্তনে মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে নায়ককে নায়ক বলেই পরিচিতি দিক সে আশায়।